
-পেঁয়াজ দিয়ে বেশ ভালো করে ঝাল রাঁধবেন? একবারে টাটকা নদীর মাছ। কিন্তু ১৫০ টাকার কমে দিতে পারব না।
-খালবিলের মাছ তাও আবার ১৫০ টাকা কেজি?
-খালবিল এখন আর কোথায় বাবু? এই বাজারে আর একজনের কাছেও এই দামে খলসে, খয়রা, চাপিলা পাবেন? দাম কিন্তু কম করতে পারব না। যা বাজারদর তাতে আমারই বা পোষাবে কেন?
নৃপতিবাবু খানিক দাঁড়ালেন। সেই কবে শেষ যে খয়রা মাছ ভাজা খেয়েছিলেন মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। অনেকটা তেল লাগে এই মাছ ভাজতে। তা তেলের যা দাম, তাতে স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে এখন কম খাওয়াই যুক্তিযুক্ত। ছোটমাছ যদিও স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। কিন্তু একে মাছের এই দাম, তায় একটু পেঁয়াজ না দিলে এইসব মাছ কি রান্না করা যায়? পেঁয়াজের দাম কমলই না এবার! আফগানিস্তান থেকে নাকি আমদানি করেছে এবার পেঁয়াজ। তাও ৫০ টাকার কম হয়নি। আলু থেকে শুরু করে মরসুমি সবজি কিসেরই বা দাম কম হয়েছে? ভাবতে ভাবতে আবদুলের গোল টাটকা লাউয়ের দিকে চোখ গেল তাঁর। তিরিশ টাকা কেজি শুনে পাশের ঝুড়িতে রাখা বেগুনের দিকে তাকালেন।
-২৫ টাকা কেজি বাবু। নিয়ে যান।
ঝুড়িটা এগিয়ে দিল আবদুল। নৃপতিবাবু কালই পেনশনের টাকা ক’টা তুলেছেন। ব্যাঙ্কের সুদ কমে যাওয়ায় এখন স্থায়ী আমানতের থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিণামও কমে গেছে তাঁর। বাজারে এসে প্রতিদিন অগ্নিমূল্য দেখে একটু একটু করে শরীর ভেঙে যেতে থাকে। যে বাজার করতে বরাবর ভালবাসতেন আজ সেই বাজারে আসলে কোনও মতে হিসাব করে কিছু কিনে বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচেন।
বাজারের থলে হাতে অবসন্ন মধ্যবিত্তের গল্প শুধু বাংলা নয় সমস্ত ভারতবর্ষেই। কৃষিপ্রধান দেশে অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি। কিন্তু আজ কৃষিজাত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই মুদ্রাস্ফীতি থেকে ক্রমশ স্ট্যাগফ্লেশনের দিকে চলে যাচ্ছে আমাদেরর অর্থনীতি। সাধারণ মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছেন। এর ফলে বাজারে যথেষ্ট চাহিদার অভাব হচ্ছে। উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ক্রমশ কমছে। আর সেই কারণে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। আজ বাইরে থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজন হচ্ছে।
দেশভাগের আগে অবিভক্ত ভারতে অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী (তখন মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীই বলা হত) তথা কৃষক পার্টির নেতা ফজলুল হক একবার বলেছিলেন, ‘পলিটিক্স অফ দ্য বেঙ্গল ইজ দ্য ইকনমিক্স অফ দ্য বেঙ্গল’। কথাটা শুধু সেইসময়ের বেঙ্গল নয় আজকের ভারতবর্ষের জন্যও প্রযোজ্য। ভারতের অর্থনীতি কৃষিপ্রধান। যে দেশে বৃষ্টি পর্যাপ্ত না হলে অথবা অতিবৃষ্টি হলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে একটা সরকার পড়ে যেতে পারে, সেই দেশে আজ কৃষি বাদ দিয়ে বেশিরভাগ লগ্নিটুকুই পরিকাঠামোর উন্নয়নে ব্যাবহার করার কথা বলা হচ্ছে।
ভারতীয় অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে যে জমির ওপর তা কৃষি। সেই শক্ত জমি এখন ক্রমশই টালমাটাল নড়বড়ে হয়ে উঠছে। যার ফলে এই স্ট্যাগফ্লেশন ও এর সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত কমে আসছে বৃদ্ধির হার। ২০১৯-২০ অর্থনৈতিক বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৪.৫% কমে গিয়েছিল। এর ফলে ২০১৯ অক্টোবরে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৫.৮% কমে গিয়েছিল। দ্রব্যমূল্যের বর্ধিত মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে একই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্বের হার। যদিও দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন, ‘ভারতের অর্থনীতি রিসেসনের মতো সংকটজনক অবস্থায় এখনও পৌঁছায় নি।’
এবার আসি একটু চাষিদের কথায়। এই বর্ধিত দ্রব্যমূল্যের জন্য কি চাষির ভাঁড়ারে মা লক্ষ্মীর কৃপা কিঞ্চিৎ বেশি দেখা যাচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম চণ্ডীগড়ের আখচাষির ছেলে মনপ্রীত সিং-এর কথায়,
-ম্যাডাম, মুঝে পাতা হ্যায় কিষাণ কা ক্যায়া হালত? ও তো মর রহ্যে হ্যায়।
বিস্তারে জানতে চাইলাম। এই বর্ধিত মূল্যের কৃষিজাত পণ্যের কিছুই কি তাদের ঘরে আসে না? আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার উল্লেখ করে উৎপাদিত দ্রব্যমূল্যের পরিবহণ খরচকেই দায়ী করা হত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিশেবে। কিন্তু এখন এর সঙ্গে জুড়েছে বেশ কয়েকটা ইন্ডিরেক্ট ট্যাক্স। বিশেষত জিএসটি। গুডস এণ্ড সার্ভিস ট্যাক্স। তাই পরিবহণ থেকে প্রোকিউওরমেন্ট সবেতেই এই জিএসটির কারণে যে বাড়তি টাকা খরচ হচ্ছে তা মিডিলম্যান বা ফড়েরা নিজেদের ঘর থেকে তো দেবেন না? তাই দায় গিয়ে পড়ছে সেই ক্রেতাদের ওপরেই। পরিণাম কৃষিজাত দ্রব্যমূল্য ও তার সঙ্গে অন্যান্য আনুষঙ্গিক দ্রব্যেরও অস্বাভাবিক হারে মূল্য বৃদ্ধি অথচ কৃষকের ঘরে সেই ঋণ জর্জরিত দুর্দশাই সঙ্গী।
বিষয়টা বুঝতে মনপ্রীতের কাছে শোনা কথাটাই উল্লেখ করলাম। ওদের গ্রামে বেশিরভাগ জমিতেই আখ চাষ হয়। এই আখ চাষে একর প্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। এবার উৎপাদিত আখ চলে যায় স্থানীয় একটি চিনির কারখানায়। সেই চিনির কারখানা থেকে যে পেমেন্ট চাষি পাচ্ছে তা চাষির ব্যাঙ্ক একাউন্টে চলে আসে। কিন্তু এই পেমেন্টটি একাউন্টে তৎক্ষণাৎ আসে না। চাষির একাউন্টে টাকাটা আসতে আসতে ৮ থেকে ১০ মাস সময় পর্যন্ত লেগে যায়।
উৎপাদনের খরচের পর চাষির হাতে আট দশমাস চালানোর মতো যথেষ্ট টাকা কি থাকে? তাঁদের খাওয়া পরা, বাচ্চার শিক্ষাখাতে খরচ, চিকিৎসা খাতে খরচ, ছেলে মেয়ের বিয়ে অন্নপ্রাশন, খুতনা, পুজো, আর্চা, শ্রাদ্ধ, মানত এইসব লোক লৌকিকতা ও সামাজিকতার কারণে বিভিন্ন ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। অথচ টাকা হাতে না থাকার দরুন কৃষক বাধ্য হয় চওড়া সুদে টাকা ধার নিতে। এরপর ৮-১০ মাসবাদে কৃষকের ব্যাঙ্ক একাউন্টে টাকা এলেও বেশিরভাগ চলে যায় ঋণ শোধ করতে। ঋণ শোধ করার পরও যদি কিছু টাকা বেঁচে থাকে, তাহলে তা আগামী মরসুমে চাষের খরচের জন্যই ব্যয় করতে হয়। অনেকের ক্ষেত্রে সেই টাকাও আবার লোন নিতে হয়। এইভাবেই ঋণের চক্র ভিসাশ সার্কেল গড়ে ওঠে।
আর যাঁরা ঋণ শোধ করতে পারেন না, সেইসব দরিদ্র চাষিদের পরিণতি আমরা খবরের কাগজে বা সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে জানতে পারি। সেগুলো নিয়ে লিখলে লাইক কমেন্ট শেয়ারও হয় আমাদের লেখা। কিন্তু একটাও আত্মহত্যা কি আমরা আজও রুখতে পেরেছি? বদলেছে কি কিছু?
মুদ্রাস্ফীতি, স্ট্যাগফ্লেশনের সঙ্গী হিসাবে নেট ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বৃদ্ধির হার কমে আসছে। আরেকদিকে ২০১৬-এর শেষের দিকে ডিমানিটাইজেশনের কারণে সরকারের যথেষ্ট কর আমদানি হচ্ছে না। জিএসটি-র কারণে সাধারণ মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বোঝাই শুধু বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তার কারণে নেট এক্সপোর্ট কমে গিয়েছে ২০১৯-২০ অর্থনৈতিক বছরে। এইসব অনিশ্চয়তার দোসর সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট এক্ট। সারা দেশে এনআরসি, সিএএ, এনপিআর বিষয়ক তুমুল রাজনৈতিক বিক্ষোভ। আসলে এই পুরো সময়টাই ভোর ভাঙানোর।